কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ইতিকথা

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ইতিকথা

2 views

Sojibul Alam Bhuiya

February 9, 2025 at 4:46:29 PM

বিজ্ঞানচারীর গত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ইশ্বর কণা ( God Particle )। যা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান (Quantum mechanics) এর একটি অংশ। তাই এই সংখ্যায় আলোচনা করবো কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান বা Quantum Mechanics সম্পর্কে। তো চলুন শুরু করা যাক।

প্রথমে জেনে আসি কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান বা Quantum Mechanics কি? সহজ ভাষায় বলতে হলে এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা। যা পরমাণু এবং অতিপারমাণবিক কণার মাপকাঠিতে পদার্থের আচরণ বর্ণনা করে। পদার্থ বিজ্ঞানের যেসব ক্ষেত্র চিরায়ত ক্লাসিকাল বা নিউটনীয় বলবিজ্ঞান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না সেখানেই বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে থাকেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কে ব্যবহার করে যেমন বিশাল কোন বস্তু। যেমন: তারা ও ছায়াপথ এবং বিশ্বতত্ত্বমূলক ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়। তেমনি স্ট্যান্ডার্ড মডেলভিত্তিক মহা বিস্ফোরণ (বিগ ব্যাং) বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করা যায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স রসায়ন, আণবিক জীববিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স, কণা পদার্থবিজ্ঞান, ন্যানোটেকনোলজি, প্রযুক্তিবিদ্যার আধুনিকায়নের ভিত্তি এবং বিজ্ঞানের কোয়ান্টামভিত্তিক শাখাগুলোকে রাতারাতি এনালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত করেছে।

এবার আসা যাক এর ইতিহাস নিয়ে। স্যার আইজাক নিউটন ১৬৮৬ সালে তার বিখ্যাত বই Philosophiae Naturalis Principia Mathematica, সংক্ষেপে প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা-তে চিরায়ত বলবিজ্ঞানের মূলসূত্রগুলি লিপিবদ্ধ করেন। যার পরবর্তী দুইশত বছর বিজ্ঞানীরা পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ঘটনাগুলোকে ব্যাখা করতে এই সূত্র গুলোকেই ব্যবহার করেন। ১৯শ শতকে এসে দেখা যায় পরমাণুর ইলেক্ট্রনীয় গঠন ও আলোর ধর্মের কিছু আবিষ্কারকে ক্লাসিকাল বলবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ১৯০৫ সালে স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন এটা ব্যাখ্যা করার জন্য নির্মাণ করেন আপেক্ষিকতাভিত্তিক বলবিজ্ঞান নামের শাস্ত্র। ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ ১৯০০ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে বেশ কিছু পদার্থবিজ্ঞানী (মাক্স প্লাংক, নিল্‌স বোর, আলবার্ট আইনস্টাইন, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, লুই দ্য ব্রয়ি, এর্ভিন শ্র্যোডিঙার, প্রমুখ) কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান উদ্ভাবন করেন। যদিও আপেক্ষিকতাবাদের সাথে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের একত্রীকরণের ব্যাপারে তাত্ত্বিক গবেষণা চলছে। এ বিষয়ে এখনও সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করা যায় নি।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের (Quantum Mechanics) ভিত্তি: কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল ভিত্তি হলো পদার্থ এবং শক্তির আচরণের প্রাথমিক নিয়মগুলো। এর মূল ভিত্তি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে:

  1. অসীম সম্ভাব্যতার নীতি (Principle of Superposition): কোনো কোয়ান্টাম সিস্টেম একই সাথে একাধিক অবস্থানে থাকতে পারে, যতক্ষণ না সেটি পরিমাপ করা হয়।

  2. অনিশ্চয়তার নীতি (Heisenberg's Uncertainty Principle): একই সময়ে কোন কণার নির্দিষ্ট অবস্থান এবং গতি নির্ণয় করা অসম্ভব। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অনিশ্চয়তা সবসময় বজায় থাকে।

  3. কোয়ান্টাইজেশন (Quantization): শক্তি, ভর, চার্জ ইত্যাদি কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পরিমাণে (কোয়ান্টা) থাকতে পারে, যা নিরবচ্ছিন্ন নয়।

  4. তরঙ্গ-কণা দ্বৈততা (Wave-Particle Duality): কণাগুলো (যেমন: ইলেকট্রন বা ফোটন) কখনও কণা হিসেবে আচরণ করে, আবার কখনও তরঙ্গ হিসেবে আচরণ করে।

  5. পরিমাপ সমস্যা (Measurement Problem): কোনো কোয়ান্টাম সিস্টেম যখন পর্যবেক্ষণ করা হয় তখন এটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় পতিত হয়, যেটিকে বলা হয় wave function collapse।

আবার, কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান (Quantum Mechanics) প্রধানত এই তিনটি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি তত্ত্ব কোয়ান্টাম স্তরে পদার্থ এবং শক্তির আচরণ বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তত্ত্ব গুলো হলো:

১. শক্তির কোয়ান্টায়িত নীতি (Quantization of Energy) এই নীতি বলে যে শক্তি একটানা বা অবিরাম নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের কোয়ান্টাম আকারে বিভক্ত। এটি প্রথমত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন নিয়ে করা কাজ থেকে আসে। যেখানে দেখা যায় যে শক্তি E = nhf কোয়ান্টাম আকারে নির্ধারিত হয় (যেখানে n হলো পূর্ণসংখ্যা এবং h হলো প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক)। এর থেকে বোঝা যায় যে ইলেকট্রনগুলোর শক্তি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকতে পারে। এই তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল ভিত্তি স্থাপন করে এবং এটিই প্রথম কোয়ান্টাইজেশনের ধারণা নিয়ে আসে।

২. ডি-ব্রগলির কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (De Broglie’s Wave-Particle Duality) ডি-ব্রগলি প্রস্তাব করেছিলেন যে সমস্ত কণার (যেমন ইলেকট্রন) একটি তরঙ্গ প্রকৃতি থাকে, এবং তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য λ=h/mv দ্বারা নির্ধারিত হয় (যেখানে p হলো কণার ভরবেগ, এবং h হলো প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক)। এই তত্ত্ব কণা ও তরঙ্গের মধ্যে দ্বৈততার একটি ধারণা প্রবর্তন করে, যা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানকে বর্ণনা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৩. হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি (Heisenberg's Uncertainty Principle) হাইজেনবার্গের এই নীতি বলে যে আমরা একই সময়ে একটি কণার অবস্থান এবং ভরবেগ (momentum) খুব নির্ভুলভাবে জানাতে পারি না। এটি ∆x∆p ≥ h/4π দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই নীতি বলে যে আমাদের পরিমাপে সর্বদা একটি নির্দিষ্ট সীমার অনিশ্চয়তা থাকে। এই অনিশ্চয়তা কোয়ান্টাম সিস্টেমের স্বভাবিক বৈশিষ্ট্য।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগ: আজকের বিশ্বে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, এমআরআই মেশিন, লেজার প্রযুক্তি—এই সব ক্ষেত্রেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব কার্যকরী। এছাড়া আলো-নিঃসরণকারী ডায়োড, ট্রানজিস্টর, মেডিকেল ইমেজিং, ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ এবং অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রের মতো জিনিসগুলির বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার: কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদেরকে পদার্থের গভীরতম স্তরে নিয়ে যায়। যেখানে বাস্তবতা আমাদের পরিচিত ধারণাগুলোর বাইরে চলে যায়। এটি বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যা মানব ইতিহাসে অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, আবার একই সাথে নতুন প্রশ্নও তৈরি করেছে।

  • সজিবুল আলম ভুইয়া